তাঁদের গল্পটা অন্য রকম। আমরা যখন ঘরে থেকে থেকে ক্লান্ত, বিরক্ত। তাঁদের তখন নির্ঘুম রাত, ব্যস্ত দিন। রক্তপাতহীন এক লড়াইয়ে তাঁরা যেন ক্লান্তিহীন যোদ্ধা। গ্রাম থেকে গ্রামে, বাজার থেকে বাজারে, দেশ কি বিদেশে তাঁরা ছুটে চলেছেন দিনরাত। সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ছুটে চলেছেন প্রশাসন ক্যাডারের এসকল কর্মকর্তা।
আজকের পর থেকে অবশ্য তাঁদের আপাত ছুটি। আমিনুল, মোর্শেদ, হিমাদ্রী, ফারজানা, তানিয়া, আব্দুল মতিন খানরা এখন বাধ্যতামূলক ছুটিতে আছেন। আছেন আইসোলেশনে।
মানুষকে ঘরে রাখতে কখনো হ্যান্ড মাইক আবার কখনও মোবাইল কোর্টের কঠোর বার্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন উপজেলা থেকে গ্রাম পর্যন্ত। মানুষকে সচেতন করে করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে অক্লান্ত শ্রম দিয়ে যাচ্ছিলেন প্রশাসন ক্যাডারের এসকল কর্মকর্তারা। রাত-দিন, সকাল-দুপুর সবই যেন চলছিল সমান তালে। সামাজিক নিরাপত্তা ও অসহায় মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করতে ত্রাণ বিতরণ, বাজার তদারকিসহ সকল কর্মকাণ্ডেই সরব উপস্থিতি ছিল তাঁদের। নিজেদের নিরাপত্তার কথা না ভেবে মানুষের নিরাপত্তায় কাজ করে যাচ্ছিলেন তাঁরা। সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে ছিলেন নিরলস।
সৌদি আরবের লেবার কাউন্সিলর মো. আমিনুল ইসলাম, গাজীপুরের টঙ্গী রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. গোলাম মোর্শেদ খান পাভেল, কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিমাদ্রী খীসা এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া তাবাসসুম, ফারজানা আক্তার, আবদুল মতিন খান সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আজ নিজেরাই আক্রান্ত হয়েছেন করোনা ভাইরাসে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা এতদিন ছিলেন মানুষের পাশে মানবিকতার উদাহরণ হয়ে আজ তাঁদের জীবনই ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা তাঁদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি।
মাঠ পর্যায়ে সরকার ও জনগণের আশা ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল জেলা প্রশাসন তথা জেলা প্রশাসক, উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। বাংলাদেশ এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের যত কর্মকর্তাই আক্রান্ত হউক না কেন করোনার বিরুদ্ধে চলমান এই যুদ্ধে জয়ী না হওয়া পর্যন্ত এই সার্ভিসের সকলে থাকবেন জনগণের পাশে। থাকবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আস্থা হয়ে।
করোনা মোকাবেলায় দেশে যে ভাইরাস যুদ্ধ শুরু হয়েছে সেই যুদ্ধে সবাই অংশগ্রহণ করেছে। সমান তালে। চলমান যুদ্ধে সবাই যোদ্ধা। সিভিল সার্জন যদি সামনের সারিতে থাকেন তবে পিছন সারি থেকে পিপিই যোগাতে থাকেন গার্মেন্টস কর্মী। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করলে স্বেচ্ছা সেবক থাকেন সচেতনতায় মাইক হাতে। বিদ্যালয়গামীরা বাসায় আবদ্ধ থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়গামীরা বানাতে থাকেন সেনিটাইজার। প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সারা দিয়ে মাঠে আছেন সেনাবাহিনীও।
চলমান যুদ্ধে বাংলাদেশের সবাই সৈনিক। সবাই নেতা। আর তাতে অগ্রণী দায়িত্ব পালন করছে প্রশাসনের কর্মকর্তারাই। নেতৃত্ব দিচ্ছে সামনে থেকে। সবোর্চ্চ ত্যাগও স্বীকার করতে হচ্ছে প্রশাসন ক্যাডারকে। দুনীতি দমন কমিশনে পরিচালক বিসিএস প্রশাসন সার্ভিসের ২২তম ব্যাচের জালাল সাইফুর রহমান ছিলেন একজন দক্ষ, সৎ, বিনয়ী, মিতভাষী এবং খুবই পরিশ্রমী কর্মকর্তা। নিজের জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি ব্রত ছিলেন জনগণের কল্যাণে। চলমান করোনা যুদ্ধে প্রশাসন ক্যাডার হারিয়েছে তাঁকে। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ সফল হবে এই যুদ্ধে। তখন হয়তো এই সফলতার ভাগীদার হতে টানাটানি পড়ে যাবে চারদিকে। আর তখন হয়তো আমরা প্রশাসনের কর্মরতরা বিদ্ধ হতে থাকব নানান প্রশ্নবাণে। কেন লোকে হাঁচি দেয়ার সময় রুমাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল না কোন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট? কারও কাশির উদ্রেক হলে কেন আগে থেকেই বুঝতে পারল না ইউএনও সাহেব? আর কি করলে কি হতে পারত? কেন আরো অনেক কিছু করতে পারেন নাই জেলা প্রশাসক?
সর্বোচ্চ শ্রম, মেধা, আন্তরিকতা আর পেশাদারিত্ব দিয়ে প্রশাসনের প্রতিটি সৈনিক আজ যুদ্ধের ময়দানে। যেমনটি ছিল বিগত দিনে আইলা, সিডর, বন্যা কিংবা আগুন সন্ত্রাস মোকাবেলায়। ভবিষ্যতেও তাঁরা মাঠে থাকবে উন্নয়নের অংশীদার হয়ে, স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে।
লেখক: ২২তম বিসিএস ক্যাডার (প্রশাসন)।