দুনিয়াজুড়ে প্রায় সব দেশই লকডাউনে। আইসোলেশন আর সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং চর্চা করছে করোনা থেকে বাঁচার পথ হিসেবে। এ ছাড়া আপাতত বিকল্পও নেই। লকডাউন দিয়ে করোনা থেকে চিরতরে মুক্তি পাওয়ার উপায় নেই; কিন্তু আক্রমণ ছড়িয়ে পড়া আটকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা হচ্ছে একরকম ঠেকা দিয়ে রাখা! যত দিন ভ্যাকসিন না আসবে তত দিন মুক্তির আশা করা কঠিন।
কিন্তু কথা হচ্ছে, কোন দেশ কিভাবে লকডাউনে গেছে সেটা দেখা। সুইডেন মডেল অনুযায়ী, সেই অর্থে কোনো লকডাউন নেই। জনগণের সচেতনতার ওপর সুইডিশ সরকারের বিশ্বাস প্রবল। তাই বলে দিয়েছে—তোমরা সচেতন নাগরিক, নিজেরা নিজেরাই একটু আইসোলেশন চর্চা করো। সব ওপেন, জরুরি সব কাজ সবাই করবে; কিন্তু সচেতনভাবে। বাস্তবে এটা হলো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতি। তবে অর্থনৈতিক ভবিষ্যত্ চিন্তা করলে এবং যদি দেখা যায় আক্রান্ত হয়ে অস্বাভাবিক সংখ্যায় মানুষ মারা যায়নি, তাহলে এই পদ্ধতি কার্যকর। অগ্রিম কেউ জানে না কী হবে, বড় বড় বিশেষজ্ঞ অসহায় বোধ করছেন।
যেহেতু এই মুহূর্তে আমি যুক্তরাজ্যে আছি, এখানকার লকডাউন এ রকম—সবাই ঘরে থাকো। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাবে না। জরুরি প্রয়োজন বলতে খাদ্যদ্রব্য কিনতে, ওষুধ আনতে, ডাক্তার দেখাতে যেতে পারবে। আর প্রত্যেক নাগরিক দিনে একবার শরীরচর্চা করতে বাইরে যেতে পারবে; যেমন—হাঁটা, দৌড়ানো অথবা সাইক্লিং। ফুড স্টোর বাদে সব রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট, মার্কেট, পাব, বার, ভার্সিটি, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি বন্ধ থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রেও আমার জানা মতে এ রকম লকডাউনই হচ্ছে।
আমার আলোচনার মূল বিষয়—গ্লোবাল ফুড সাপ্লাইয়ের কী হবে?
এটাই চলমান লকডাউনের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ। ইউরোপ-আমেরিকা খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে মূলত চেইন স্টোরের ওপর নির্ভরশীল।
Asda, Tesco, Sainsbury, Aldi, Iidl, Walmart, Costco, Co-op—এসব হলো জায়ান্ট সব ফুড চেইন কম্পানি। হাজার হাজার কোটি টাকার এন্টারপ্রাইজ এরা। উন্নত দেশগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ ফুড আইটেম এরা অ্যাসেম্বল ও ডিস্ট্রিবিউট করে।
এই লকডাউন আর আইসোলেশনকালে অন্য সব ব্যবসা স্থবির থাকলেও এদের কার্যক্রম শতভাগ চালু আছে। এদের সরবরাহকারী (supplier), উৎপাদকসহ (producers) ব্যাকওয়ার্ড সাপ্লাই চেইনের কোনো কার্যক্রম ব্যাহত হয়নি। বিশাল বিশাল লরি, কাভার্ড ভ্যান, যানবাহনে করে খাদ্যদ্রব্য আনা হচ্ছে, স্টোরে রাতে রাতে খালাস (unload) করে তাকে তাকে সাজিয়ে ফেলা হচ্ছে। সকাল থেকে সব সাজানো পাওয়া যাচ্ছে। কয়েক দিন পাগলামি কেনাকাটার (panic buy) কারণে কিছু জিনিস পাওয়া যাচ্ছিল না। এখন সব আবার স্বাভাবিক।
আমি ধারণা করি, উন্নত বিশ্ব যেকোনো কিছুর বিনিময়ে হলেও ফুড সাপ্লাই চেইন চালু রাখবে। দুধ, ডিম, আলু, পেঁয়াজ, চাল, ডাল—সব কিছুর দামই এখনো স্বাভাবিক আছে, বাড়েনি। বিশ্বব্যাপী কেউ খাদ্যদ্রব্য পরিবহনে কোনো ঝামেলা হতে দেয়নি এখনো। যুক্তরাজ্যে ফল, সবজি, মসলাসহ অনেক জিনিস কোস্টারিকা, ব্রাজিল, কলম্বিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে আসে। গ্লোবাল লকডাউনেও এতে ব্যত্যয় ঘটেনি।
অন্যদিকে বাংলাদেশে গ্রামে-গঞ্জে লকডাউন শতভাগ বাস্তবায়ন করা যায়নি! জিনিসটা আসলে কঠিনই। এত ছোট একটা দেশে ১৮ কোটি মানুষ থাকলে যেকোনো পদ্ধতিই কাজ করানো মুশকিল। আর যদি জনগণের বড় একটা অংশ অসচেতন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অশিক্ষিত হয়, তাহলে কী হওয়ার সেটা অনুমেয়! এ নিয়ে সমালোচনা, গালাগালি করা যাবে; কিন্তু দিন শেষে বাস্তবায়ন বড়ই কঠিন!
আমাদের ফুড সাপ্লাই চেইন থমকে গেছে। গ্রাম থেকে উপজেলা, উপজেলা থেকে জেলা, জেলা থেকে বিভাগের যোগাযোগ বন্ধ। ফলে গ্রামে-গঞ্জে উৎপাদিত আলু, মুলা, সবজি, দুধ, ডিম শহরে যেতে পারছে না।
সাপ্লাই চেইন নিয়ে গবেষণার কারণে দেশের খামার ও উৎপাদনের খোঁজখবর রাখি। করোনার লকডাউনে তার ওপর কেমন প্রভাব পড়ছে, তা জানতে প্রান্তিক খামারি পর্যায়ে যোগাযোগ রাখছি। যে খবর পাচ্ছি, তাতে খামারিদের মধ্যে শঙ্কা কাজ করছে। আমাদের পুরো খাদ্য সরবরাহ লাইনে স্বপ্ন, আগোরা, মীনাবাজার ধরনের সারা দেশে ৮-১০টি বড় ফুড চেইন শপ আছে। তবে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের খাদ্যের সাপ্লাইয়ে এদের ভূমিকা নগণ্য। আমাদের পুরো বাজারব্যবস্থা কৃষক থেকে ব্যাপারী, ক্ষুদ্র দোকানি, গ্রাম্য বাজার, শহুরে কাঁচাবাজার, পাইকারি বাজার, ব্যক্তিগত উদ্যোগে শহুরে বাজারে বা ঢাকায় সাপ্লাই—এভাবেই চলছে।
একটু চিন্তা করে দেখুন, উত্তরবঙ্গে উৎপাদিত সবজি, বগুড়ার আলু, কুমিল্লার টমেটো, বরিশালের ধান যদি ঢাকায় ঢুকতে না পারে, কী অবস্থা হবে? আরো ম্যাক্রো লেভেলে ভাবা যেতে পারে। ধরুন, কুমিল্লার দাউদকান্দিতে একজন কৃষক আলুর চাষ করলেন তাঁর সব মূলধন দিয়ে। এই মৌসুমে তিনি আলু মাড়াই করলেন কিন্তু দাউদকান্দিতে নিয়ে যেতে পারছেন না বিক্রি করতে। ফলে তাঁর হাতে টাকা আসছে না। তাহলে তিনি চাল, ডাল, অন্য জরুরি খাবার কিনবেন কী দিয়ে? আরেকজন হয়তো পেঁয়াজ বা অন্য কিছুর চাষ করেছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই বিপদে। এই ফসল উপজেলায়, জেলায়, ঢাকায় যেতে না পারলে বাকি সবাই খাদ্যদ্রব্যের সংকটে পড়তে বাধ্য।
আরেকটা জিনিসের অগ্রিম প্রস্তুতি নিয়ে রাখা ভালো। এর মধ্যেই সারা দুনিয়ায় অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছে। এটা বিপর্যয় লেভেলে চলে যেতে পারে। সেই হিসাবে বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে। আর আন্তর্দেশীয় ও আন্তর্মহাদেশীয় খাদ্য সরবরাহ মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হতে পারে। অন্য দেশগুলো যদি নিজের অনিশ্চয়তা কাটানোর প্রয়োজনে দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য মজুদ করে, তাহলে আমাদের বিপদ হতে পারে। বাংলাদেশে ফুড সাপ্লাই মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।
সে ক্ষেত্রে নিজস্ব খাদ্য উৎপাদন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কৃষকদের উৎপাদনে রাখা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের উৎসাহিত করা, মাঠে রাখা প্রয়োজন। এখন কোনো খামারি, কোনো কৃষক যদি তাঁর নিজস্ব ফসলাদি, খাদ্যসামগ্রী বিক্রি করতে না পারেন, তিনি আর্থিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাবেন এবং পরবর্তী ফসল ফলানোর জন্য মাঠে যাবেন না, মূলধন পাবেন না। বীজ ও সার কিনতে পারবেন না। ফলে উৎপাদনের উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন।
যদিও সবাই এখন করোনাভাইরাস নিয়ে চিন্তিত, ভীত, তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু আজ থেকে তিন মাস পর বা আরো পরে কী হতে পারে, স